বিয়ে,স্বামী-স্ত্রী গুরুত্ব হক না বোঝার দাম্পত্য জীবনে অশান্তির করুণ বাস্তবতা!!

 বিয়ে,স্বামী-স্ত্রী গুরুত্ব হক না বোঝার দাম্পত্য জীবনে অশান্তির করুণ বাস্তবতা!!


পরিচিত বড় ভাই। বিয়ের প্রথম বছর। টানা কয়েক মাসের ইফোর্টে নতুন সংসার গুছিয়ে এনেছেন। একরকম ক্লান্ত হয়েই অফিসের কয়েকজন কলিগের ফ্যামিলির সাথে কুয়াকাটা ট্যুরে গেলেন। যাকে বলা চলে 'বিলম্বিত হানিমুন'।


ট্যুরের উদ্দেশ্য ছিলো ফ্রেশ হয়ে আসা। 

ট্যুরের পরে অদ্ভুত কিছু ঘটলো। ভাবী একদম অন্যমনস্ক, মুখ ভার করে থাকেন সবসময়। ভাই জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। ঘরের কাজও করে দায়সারাভাবে।

মহা ঝামেলা। পরে ভাবীর আত্মীয়ের মাধ্যমে জানা গেলো ঘটনাটা।


ট্যুরের জন্য ভাইয়ের একজন কলিগকে লিডার বানানো হয়েছিলো। ভাবীর ভাষ্য অনুযায়ী, ওই লিডার কলিগের সবকিছু নিজ হাতে ম্যানেজ করা, যেকোনো ইস্যুতে সবার আগে এগিয়ে যাওয়া, স্থানীয়দের সাথে ঝামেলা হয়েছিল - সেটা এগিয়ে গিয়ে সমাধান করা, হোটেলে সবার খাওয়া নিশ্চিত করে তারপর নিজে খাওয়া - ব্যাপারগুলো তাকে খুব প্রভাবিত করেছে।


ব্যাপারটা আরো কন্ট্রাস্ট হয়ে গেছে তার নিজের স্বামীর কারণে। তার স্বামী, মানে ভাই পুরোটা সময় ব্যস্ত ছিলেন ফোনে। ছোটখাটো ব্যপার যেগুলো নিজে সমাধান করা যেত সেগুলোর জন্যও সেই লিডারের শরণাপন্ন হয়েছেন। ইভেন তার স্ত্রী বাথরুমে যাবে, সেটাও সেই লিডারকে বলে ব্যবস্থা করেছেন।


ভাবীর ব্যপারটা ইউনিক। তিনি যদি বলতেন, ওই লিডার কলিগকে তার ভালো লেগেছে, তাহলে ব্যাপারটা সিম্পল হতো, পরকীয়া টাইপ। কিন্তু তার কথা হলো, তিনিও তো সেইম ফিনান্সিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যেই একজন ওরকম মাসকুলিন স্বামী পেতে পারতেন। সেটা পাননি এবং এরকম দায় এড়ানো কারো সাথেই তার বাকি জীবন কাটাতে হবে ভেবে আপসেট।


পরে ভাইকে বলা হলো, আপনি কী আশা করেছিলেন আসলে? নিজের স্ত্রীকে এতগুলো পরপুরুষের সাথে এত ক্লোজ প্রক্সিমিটিতে রাখলেন, যেখানে আপনি নিজেই ইন্ট্রোভার্ট।  এখন হয় একজন মেন্টরের কাছ থেকে এসব সংশোধন করেন, নইলে বউকে নিয়ে আরেকটা ট্যুরে যান, সংসার আর করা লাগবে না।


■■ ভাই একা দায়ী?


এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য উক্ত ভাই একা দায়ী, এটা ভুল। মাস্কুলিনিটি-লিডারশীপ ২৫ বছরের শিক্ষাজীবনের কোথায় শেখানো হলো? 

আর ফ্যামিলি? বলেই দিয়েছে, 'কোনো ঝামেলায় জড়াবি না'। ছেলেরা দায়িত্ব নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া শিখবে কিভাবে?


এরপরে রয়েছে সংসার। ইউনিভার্সিটিগুলোতে এত ধরণের প্রোগ্রাম হয়, 'নকশীকাথার ইতিহাস', 'কেচো চাষের গুরুত্ব', 'দেশে ব্যান্ড সংগীতের বিবর্তন' - আচ্ছা এগুলো তো অলমোস্ট ইউজলেস। কিন্তু এই ভার্সিটি থেকে বেরোনো মাত্রই যে স্বামী হওয়া লাগবে, এবং তা সবারই - সে বিষয়ে কতটুকু পড়ানো হয়?

জিরো।


এখানে অনেকে বলে, সব শিখিয়ে দিতে হবে কেন? বা ফ্যামিলির ভাষায়, 'বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে'।

হ্যাঁ, ছেলে শিখছে ঠিকই, বিয়ের প্রিপারেশন নিচ্ছে চটি পড়ে আর সংসার করা শিখছে ফেসবুক গ্রুপ আর প্রথম আলো থেকে।


পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা শিখতে হয় না - জুতো পরা থেকে আগুন ধরানো। এখন লাইফের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বড় ব্যাপারগুলোতে তরুনকে যদি নিশ্চিতভাবে সঠিক শিক্ষা না দেওয়া যায়, কোনো গ্যারান্টি নেই সে ঠিকমত শিখেছে কিনা। এটা কেবল ভুল করার পরেই জানা যায়।


এর পরিণতি ভালো হচ্ছে না, স্বাভাবিকভাবেই। পরের পয়েন্টটি দেখুন। 


■■ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা


আধুনিক বিয়ে মানে ব্যাপারটা এরকম - দুটো ছেলে-মেয়েকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের আগে কিন্তু বলা হয়নি কোথায় পা ফেলতে হবে বা ফেলা যাবে না - একদম কিছু না। কিন্তু তারা ভুল করামাত্রই পাশ থেকে স্বজনেরা হা-রে-রে করে তেড়ে আসছে শাস্তি দিতে। নবদম্পতির কোন আইডিয়াই নেই তারা কী ভুল করেছে, বা আদৌ ভুল করেছে কিনা। কেবল জানে কালকের খুবই ফ্রেন্ডলি কয়েকজন আত্মীয় আজকে থেকে হঠাৎ খুবই আপসেট।


একটা ঘটনা শেয়ার করি। আমার একজন পরিচিত মজলুম আলেম, হাসিনার পুলিশ তার লাইফটাই এলোমেলো করে দিয়েছে। জেলে ছিলেন। সময়মত লাইফ গোছাতে পারেননি। এত অসহায় আর লোনলি ছিলেন, দেখে খুব কষ্ট হতো। আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন।

একদিন ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াত পেলাম। কত খুশি ছিলাম, শুধু আমি না, উনাকে যারা চিনতেন- সবাই। 

বিয়েতে যেতে পারিনি। পরে একদিন দেখা। বললাম, এতদিন পর লাইফের একটা গতি হলো, আপনি নিশ্চয় হ্যাপি।

উনি যা শোনালেন, স্পিচলেস হয়ে গেলাম। বিয়ের দিন মধ্যরাতে তার কয়েক ঘন্টা আগে বিয়ে করা স্ত্রীকে দিয়ে তার বড় ভাবীর পায়ে ধরতে বাধ্য করা হয়েছে। তার ভাবী নাকি কী কারণে খেতে আসেনি, সেই রাগ ভাঙ্গাতে।


হোয়াট!?


■■ ছেলেরাই চূড়ান্ত ভিকটিম


আমার কিছু বিবাহিত ভাই-বন্ধুর কনসোলিংয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কী নিয়ে সেটা আপনারা জানেন, মা-বৌ ইমব্যালান্স।

ফেসবুক গ্রুপগুলোতে এরকম পরিস্থিতি কেউ জানালে তার নিচে কমেন্টগুলো খুবই কমন থাকে - 'মা-বৌ ব্যালান্স না করতে পারলে বিয়ের দরকার কী?' 'কারো দিকে ঝুঁকে পড়বেন না' ইত্যাদি ইত্যাদি।


কিন্তু কেউ বলছে না, হাউ? দুইজন নারীর মধ্যের এই অত্যন্ত কমপ্লেক্স পরিস্থিতি ম্যানেজ করার জ্ঞান সে কি গায়েব থেকে পাবে? এ এমন এক পরিস্থিতি, সারাজীবনের মেন্টর বাবা-মা আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলবে না, বৌ তার নিজের ডিমান্ড নিয়ে দরজা আটকে পড়ে রইলো, আর ত্রিমুখি ঝগড়ার সমস্ত ব্লেইম এসে পড়বে ছেলেটার উপর।

সব তার দোষ। 


এক ২৫-৩০ বছর রক্ত জল করে বিয়ে করার পর কোথায় একটু আনন্দে থাকবে, উলটো বাড়ির বাতাসটাও যেন তিতে লাগে।


মেয়েদের বেলায় অন্ততঃ তার বাবার ফ্যামিলিটা রয়েছে। তাদের কাছে হেল্প চাইতে পারে, পরামর্শ নেয়। ছেলে যাবে কোথায়? একটা মানিব্যাগ কেনার আগেও যেই বাবাকে জানানো যেত সেখানে তাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না।


মা জ্বর হলে ছেলের আগে টের পান, অথচ এই ব্যালান্স করতে গিয়ে ছেলে যে তীব্র যন্ত্রণায় মানসিক রোগী হবার পথে, মা বুঝতেই চান না।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, মা ছেলের কাছে ফোন করেছে। রিসিভ হয়নি। মা বললো, দেখেছিস, বিয়ের পর কেমন কথা বলা বাদ দিয়েছে। আমি বললাম, আচ্ছা, বিয়ের আগে ফোন না ধরলে কী মনে করতেন? বললেন, হয় মিটিঙয়ে আছে, কিংবা গাড়িতে। বললাম, একই ঘটনা কী এখনও ঘটতে পারে না? 


বউ মানবে না, মা-বাবাকে কিছু বলা যায় না, ভাইয়েরাও ইন্টারেস্টেড পার্টি, তাদের বলা মানে ভাবীদের মুখ ঘুরে আরেক পরিস্থিতি। বিবাহিত ছেলেরা শেষমেষ আসে আমাদের মত বন্ধুদের কাছে। পরামর্শ চায়, এদিকে আমরা নিজেরাই ব্যাচেলর। সংসারে এক বছরের মাথায় হাঁপিয়ে উঠেছে, বলে তোর ওখান থেকে একদিন ঘুরে আসা যাবে? 


বন্ধুদের যাদের সাথে এক মিনিটের বেশী কোনোদিন ফোনে কথা হয়নি, তাদের সাথেই এখন ২০-৩০মিনিট পার হয়ে যায়। সবার একই ইস্যু।


থাম্বনেইলে যে ছবিটা দিয়েছি এটার সাথে একটা সত্য ঘটনার সম্পর্ক আছে। 

মাঠের পাশে এভাবে গাছতলায় বসে  আমাকে ফোন করতো। মা-বৌ দুইজন দুই ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে, দুজনের কাছেই সে ভিলেন। এমন একটা অবস্থা, লাইফের আপন মানুষদের বলা যায় না, মা-বৌ বুঝতে চায় না, নিজের ভাইকেও বলা যায় না - ভাই নিজেও এক পক্ষ। শেষমেষ ভরসা বন্ধুরা।


ওকে বললাম, তোর সাথে যেসব ইস্যু নিয়ে কথা হয় সেগুলো নিয়ে কিছু একটা লিখি। থাম্বনেইলটা ওর সামনেই বানানো।


■■ আধুনিক মায়েদের ডুয়ালিটি


ছেলের বৌয়ের বেলায় কারারক্ষীর মত হলেও একটা ব্যাপারে মায়েদের আচরণ পুরো উল্টো। সেটা হলো ছেলের গার্লফ্রেন্ড। অনেক ফ্যামিলিতে দেখেছি, মা ছেলের গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিয়মিত ভিডিওকলে কথা বলে। সে কি হৃদ্যতার সম্পর্ক!

ভ্যালেন্টাইন ডে-তে প্রথম আলো শিরোনাম করেছিলো, মা তার ছেলের গার্লফ্রেন্ডকে বলছে, 'আমার পাগলটারে দেখে রাইখো মা'


ছেলে প্রকাশ্য ব্যাভিচারে জড়িয়ে রয়েছে, মা উলটো উৎসাহ দিচ্ছে! এই মা-ও নাকি সংসারে শান্তি চায়!


এবার ভাবুন তো এই মেয়েটাই যখন তার পুত্রবধু হচ্ছে তখন তার ওই ক্রিম মাখানো আচরণ কোথায় পালালো? মমতাময়ী মা থেকে হয়ে উঠলেন কম্পিটিটর শাশুড়ী!


শুধু ফ্যামিলিতে মা-ভাবীর ক্যাচাল দেখেও বহু ছেলে বিয়ের আগ্রহ হারাচ্ছে।


এক সিনিয়রকে বলা হলো বিয়ে করেন না কেন? বলল, মা আমাকে এখনও খাইয়ে দেয়। মা ওর সাথে আমি বাদেই অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলে। একদিকে আমার সেক্সুয়াল লাইফ ঠিকঠাক, কোনো দায়িত্ব নেই-গ্যাঞ্জাম নেই, মায়ের আদরও পাচ্ছি। আমি জানি বিয়ের পরদিনই এসব উধাও হয়ে যাবে। সেধে এই লাইফ হারাতে যাবো কেন?


মানে বিয়েকে ঠিক আর কত কঠিন করা হবে! 


■■ সংসার শিখবো কোথায়? উদাহরণ সামনেই আছে


কিছু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার পেলাম প্রি-ম্যারেজ কোর্স এবং কাউন্সেলিংয়ের উপর


 > ইরানে ১৯৯৩ সাল থেকে গ্রাজুয়েশন লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রি-ম্যারেজ কোর্স ও কাউন্সেলিং করানো হয়। এসব কোর্সের টপিক থাকেঃ

 - স্বাস্থ্য,

 - ধর্মীয় ও আইনি বিধান,

- বিবাদ মেটানো,

- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও

- কমিউনিকেশন স্কিল।

কোর্সগুলো তৈরি করা হয় অত্যন্ত অভিজ্ঞ কিছুর প্রফেসর এবং সংশ্লিষ্ট প্রফেশনালদের দিয়ে। 

একটা রিসার্স পেপার পেলাম, যেখানে দেখিয়েছে কিভাবে এসব কোর্স ডিভোর্সের হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়েছে। 


> মালেশিয়াতেও সিমিলার কোর্স রয়েছে। এছাড়া ভার্সিটিভিত্তিক নানান সংগঠন এরকম ওয়ার্কশপ ও কোর্সের আয়োজন করে। একটা কোর্সের পোস্টারের ছবি দেখলে আইডিয়া পাবেন।


> বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে এই ধরনের প্রি-ম্যারেজ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি এখনই কিছু সংগঠন কর্মসূচি হাতে নিতে পারে।


> যারা শাশুড়ী হতে যাচ্ছেন তাদের জন্য ছেলে-মেয়ের বিয়ের আগে অবশ্যই তাদের করণীয় সম্পর্কিত কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। 

বাংলাদেশে ফ্লোর মোছার জন্যও কোর্স আছে, কিন্তু শ্বাশুড়ি হওয়াটা নারীরা শিখছে কোথায়? তাদের মনগড়া কাজের কারণে পুত্রবধু তো বটেই, ছেলের উপরও মারাত্মক জুলুম করেন। যা তাদের নিজেদেরকেও মানসিক শান্তি দেয় না। এই ধরণের আয়োজন সব পক্ষের জন্যই উইন-উইন হবে।


> সর্বশেষ, বিয়ের প্রস্ততিতে সবাই যে পার্টটা স্কিপ করে যায় সেটা হলো বাচ্চার কেয়ার। বিয়ের পর ইভেনচুয়ালি বাচ্চা হবেই। ইউনিভার্সিটি পাশ গর্বিত মা-ও দেখা যায় বাচ্চার নিউট্রিশন ও সাইকোলজি সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান নেই, সারাদিন বাচ্চাকে ভাত গেলানোর ট্রাই করে যাচ্ছে। এটাও শিখতে হবে। 


পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


- আহমাদ খান

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post